- ভোগের রান্না – ভারতীয় অধ্যাত্মবাদ ও খাদ্য সংস্কৃতি
- সোমব্রত সরকার
গুড়ের সঙ্গে আতপচালের গুঁড়ি মিশিয়ে তৈরি বাংলার অতীব প্রাচীন মিষ্টি গুড়সন্দর্ভ দিয়েই গৌড়দেশের আশ্রম – আখড়াতে দেবভোগ দেওয়া হত। ক্ষীরিকা ছিল গোপালভোগের মিষ্টান্ন। দক্ষিণ ভারতে দেবতার ভোগ হয় ঘৃতপক্ক ও তেলপক্ক খাদ্যবস্তুতে। নর্মদার সাধকেরা দেবীভোগে নিবেদন করেন ঘিওড়ি। ভোগের রকমফের আছে — ক্লিন্নভোগ, দূষিতভোগ, অমৃতভোগ। তন্ত্রে রয়েছে চিতা জাগানির ভোগ, শিবাভোগ, এঁটোভোগ, কারণভোগ। ছাগলের দুধের ক্ষীর, লুচি, বুটের ডাল, শুক্তনি, ডুমুরের ডালনা, কুমড়ো – তেঁতুলের অম্বল, ভাজা, মোচার ঘণ্ট, লাউ ঘণ্ট, সোনা মুগের ডাল, পান্তা ভাত, কচুশাক — নিরামিষ অন্নভোগের পাশাপাশি দুর্গা, মনসা, রাজলক্ষ্মী, কালী পুজোর ভোগ হয় বলির পাঁঠা, হাঁস ও পায়রায় মাংসে, সঙ্গে থাকে ইলিশ, রুই, কাতলা, চিতল, পাবদা, বোয়াল মাছ। শাপলা চালের ভাত, শূকরের মাংস হয় কুচবিহারের বড়দেবীর ভোগে, বর্গভীমার ভোগে থাকে শোল মাছ। শ্মশানে পঞ্চমুণ্ডির আসনে সদাশিবের ভোগে সরায় করে দেওয়া হয় খিচুড়ি, পোলাও, মাছ, মাংস, মদ। বীরাচারীরা ভোগে দেন পাঁঠা, মোষ – ভেড়া – শুয়োর — মুরগি পর্যন্ত বলি হয়। দক্ষিণাচারীরা ফল বলি দেন। পশ্বাচারীরা ভোগ্যবস্তুর বলিদান দেন — ভাত, ঘি, মধু, চিনি, বাতাসার মিষ্টি ও ফল থাকে। রহস্য পুজোর বলির মাংস, বুড়ো শোল, পাকা রুই রান্না হয় বিশেষ নিয়মে। শ্মশানকালীর ভোগে দেওয়া হয় মাসুরি চালের ভাত। বাহান্নভোগে থাকে বিট বাটা, গুড়ি কচুর তরকারি, নারকেল বাটা, চুকাই ফলের চাটনি, ডাবের পায়েসের মতো প্রাচীন রান্না। দক্ষিণ ভারতের ভয়ঙ্করা মাতা পেরিয়াচি আম্মানের ভোগ রান্না হয় পাকা তেঁতুলের ক্কাথে ভাত মিশিয়ে। মধুমতী দেবীর ভোগ হয় কাঁচা মাংস, মাছ ও মদিরাতে। গুজরাটের বহুচরা মাতার ভোগ হয় ঘিয়ে ভাজা আটার লুচি আর আটার হালুয়া রান্না করে। মা বসুমতীর ভোগে থাকে মারিপিঠা। রান্নাপুজোর ভোগ হয় ফোড়ন ছাড়া ডালে। ভাদ্র সংক্রান্তির ভোগে থাকে পান্তা ভাত, চুনো মাছের টক। নবান্নের ভোগে রান্না হয় নতুন গোবিন্দভোগ চালের পায়েস। গ্রামদেবতার ভোগ হয় পুকুরের মাছে। পৌষলক্ষ্মীর ভোগে দেওয়া হয় আতপচাল, কলা, লবঙ্গ, আদা, এলাচি, কর্পূর দিয়ে প্রস্তুত মকরচাল। শ্রীক্ষেত্রে এদিন জগন্নাথদেবের মকরবেশ। ভোগ হয় চুরাশি রকমের ব্যঞ্জন সহযোগে। বৃন্দাবনের অতি পুরনো মঠ খুঁটার আখড়ায় ভোগ হয় বেগুনের বিরিঞ্চি দিয়ে। পটল গোবিন্দম্ ভোগ হয় জয়দেবের আরাধ্য শ্যামরূপায়। শ্রীক্ষেত্রে বিমলা মায়ের পারুষভোগ হয়। জগন্নাথদেবের রাজভোগ, ছত্রভোগ, উত্থাপনভোগ, কোঠভোগ, যাত্রাভোগ, ছাপ্নান্ন ভোগের মিষ্টান্নদি, অন্ন, ব্যঞ্জন রান্না হয় মাটির হাঁড়িতে — সুবাস পখাল, মরিচপানি, আরিষা, তিপুরি, সরপুলি, লক্ষ্মীবিলাস, মাঠপুলি, সরু অন্ন, মিষ্টিকাণিকাসহ অভিনব সব ওড়িয়া রান্নাবান্না শৈলীতে। সব মিলিয়ে ভোগের রান্না গোটা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের রান্নাবান্না ও খাদ্য সংস্কৃতির এক অভিনব সংযোজন। রান্না হয় পবিত্র মনে, ভক্তির মাধুর্যরসে, খাওয়ার আগে তা নিবেদিত হয় ভগবানের সেবার উদ্দেশে।



![Bhoger Ranna [Somabrata Sarkar]](https://boighar.in/wp-content/uploads/2025/07/Bhoger-Ranna-boighar-dot-in.jpg)
![Chalachitrajapan [Harisadhan Dasgupta]](https://boighar.in/wp-content/uploads/2018/08/Chalachitrajapan-for-web-250x320.jpg)
Reviews
There are no reviews yet.